Wednesday, June 17, 2015

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি

শ্রীকৃষ্ণ হলেন বিষ্ণুর অবতার। তার পবিত্র জন্মতিথিকে বলা হয় জন্মাষ্টমী। এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রাচীন ধর্মীয় উৎসব। দিবসটিকে কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী, অষ্টমী রোহিণী, শ্রীকৃষ্ণজয়ন্তীসহ বিভিন্ন নামেও ডাকা হয়। শ্রীকৃষ্ণকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তারা বিশ্বাস করেন, পৃথিবী থেকে দুরাচারী দুষ্টদের দমন আর সজ্জনদের রক্ষার জন্যই এ মহাবতার স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। ধর্মগ্রন্থ গীতাও সেই সাক্ষ্য দেয়।
হিন্দু পঞ্জিকা মতে, সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্য হলে জন্মাষ্টমী পালিত হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোনো একসময় দিনটি পড়ে। এবার বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে ১৭ আগস্ট।

খ্রিস্টপূর্ব ৩২২৮ সালে শ্রীকৃষ্ণ অবতাররূপে পৃথিবীতে আসেন। তার জন্মের সময় পৃথিবী পাপ ও অরাজকতায় পরিপূর্ণ ছিল। সনাতন বিভিন্ন শাস্ত্রে তার মহিমার শেষ নেই, শেষ নেই নাম ও উপাধির। ঈশ্বরতত্ত্বের মহান প্রতীক তিনি। বেদে বলা হয়েছে ঋষিকৃষ্ণ ও দেবতাকৃষ্ণ। মহাভারতে রাজর্ষিকৃষ্ণ, শাসক ও প্রজাপালক কৃষ্ণ, অত্যাচারী দমনে যোদ্ধাকৃষ্ণ। ইতিহাসে যাদবকৃষ্ণ ও দর্শনশাস্ত্রে সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ কৃষ্ণ। শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় অবতারকৃষ্ণ, দার্শনিক কৃষ্ণ, পুরুষোত্তম কৃষ্ণ ও ঈশ্বরায়িত কৃষ্ণ।
ঘোর অমানিশার অন্ধকারে জন্মগ্রহণ করায় তার গায়ের রং শ্যামল। অন্য অর্থে ধূসর, পীত, কিংবা কালো। সংস্কৃত কৃষ্ণ শব্দটির অর্থ কালো, ঘন বা ঘন-নীল। মূর্তিগুলোতে তার গায়ের রং সাধারণত কালো ও ছবিগুলোতে নীল দেখানো হয়। তার রেশমি ধুতিতে হলুদ রং ও মাথার মুকুটে একটি ময়ূরপুচ্ছ শোভা পায়। প্রচলিত মূর্তিগুলোতে তাকে বংশীবাদনরত বালক বা যুবকের বেশে দেখা যায়। একটি পা অপর পায়ের উপর খানিক বাঁকা অবস্থায় থাকে। বাঁশিটি ঠোঁট পর্যন্ত ওঠানো থাকে। ঘিরে থাকে গরুর দল। এটি তার দিব্য গো-পালক সত্ত্বার প্রতীক। কোনো কোনো চিত্রে গোপী-পরিবৃত অবস্থাতেও দেখা যায়।
সনাতন ধর্মে সময়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে একটি দ্বাপর যুগ। এ যুগের শেষদিকে মথুরা নগরীতে তার শুভ আবির্ভাব। তার জন্ম অত্যাচারী রাজা কংসের কারাগারে, যিনি কিনা তার মামা। তার জন্ম কাহিনীতে দেখা যায়, মগধ অধিপতি জরাসন্ধ ১৮ বার মথুরা আক্রমণ করে ব্যর্থ হন। তখন মথুরার রাজা উগ্রসেনের ছেলে কংসকে হাত করতে দুই মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দেন। কংস নিজেও ছিল অত্যাচারী। তার ছিল সিংহাসনের লোভ। জরাসন্ধের সঙ্গে মিলে হয়ে উঠেন আরও দুর্বিনীত। কিন্তু বংশের অন্যান্য যাদবরা চিরশত্রু জরাসন্ধের সঙ্গে আত্মীয়তাকে ধিক্কার জানায়।
একসময় কংস উগ্রসেনকে বন্দি করে সিংহাসন দখল করে। তখন আত্মীয়-স্বজন ও বিশেষ করে যাদববংশ বিদ্রোহী হয়ে উঠে। তাদের শান্ত করতে যাদববংশের শুর সেনের ছেলে বসুদেবের সঙ্গে বোন দেবকীর বিয়ে দেন। বিয়ের পর দেবকী ও বসুদেব রথে করে যাওয়ার সময় কংস দৈববানী শুনতে পান- এদের অষ্টম সন্তানই হবে তার মৃত্যুর কারণ।
কংস দেবকীকে হত্যা করতে চাইলে বসুদেব আশ্বস্ত করেন, দেবকীর সন্তান জন্ম নিলে কংসের হাতে তুলে দিবেন। কংস তাদের দুইজনকে কারাগারে বন্দি করেন। এর দশমাস দশদিন পর দেবকী এক পুত্রসন্তান জন্ম দেন। সঙ্গে সঙ্গে কংসের হাতে সন্তানকে তুলে দেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বসুদেব। এভাবে একে একে খুন হয় তাদের ছয় সন্তান।
অন্যদিকে, গোকুলে বাস করতেন বসুদেবের প্রথম স্ত্রী রোহিনী। রোহিনীকে দেবকীর সপ্তমগর্ভ দান করা হয়। জন্ম নেয় ছেলে বলরাম। আর দেবকী আবার সন্তানসম্ভবা হলে কারাগারে বসানো হয় কঠোর নিরাপত্তা। চারদিকে আলোয় উদ্ভাসিত করে অষ্টমী তিথিতে জন্মগ্রহণ করেন পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ। জন্মের সময় শিশুটি চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করেছিল। এ ছাড়া দেহে শোভা পাচ্ছিল মনিরত্নের অলংকার। বসুদেব ভক্তিতে করজোড়ে প্রণাম ও বন্দনা শুরু করেন। বন্দনা ও দেবকীর প্রার্থনা শেষে শ্রীকৃষ্ণ একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করেন। এ সময় দৈবভাবে কারারক্ষীরা ঘুমিয়ে পড়ে। তখন বসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে গোকুলে যশোদা ও নন্দের কাছে রেখে আসেন। এদের কাছে কৃষ্ণ বড় হন। বসুদেব কারাগারে যশোদা ও নন্দের সদ্যজাত মেয়েকে নিয়ে আসেন।
পরদিন কংস কারাগারে আসেন। তিনি ওই মেয়েকে মারতে গেলে দৈবভাবে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন অদৃশ্য কন্ঠ জানায়, কৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছে। এরপর কৃষ্ণের খোঁজ চলতে থাকে। কিন্তু কংস নানাভাবে ব্যর্থ হন। শ্রীকৃষ্ণ গোকূলে বড় হতে থাকেন। মুক্তির আশায় নিপীড়িত মানুষ তার অনুসারী হয়ে উঠে। অবশেষে কংস মথুরায় মল্লক্রীড়ার আয়োজন করে আমন্ত্রণ জানান শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামকে।
সেখানে কৃষ্ণকে পিষে মারার জন্য পাগলা হাতি রাখা হয়। এছাড়া থাকে চানুর ও মুষ্টির নামে দুই খ্যাতিমান মল্লবীর। কিন্তু অন্তর্যামীরূপে শ্রীকৃষ্ণ কংসের সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে মুষ্ঠির আঘাতে হাতি, মুষ্টির ও চানুকে হত্যা করে। কংস সেনাদের অস্ত্র ধারণ করতে বললেও কেউ সাড়া দেয় না। তখন কংস নিজেই অস্ত্রধারণ করে। কিন্তু কৃষ্ণের লৌহমুষ্ঠির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এভাবে মথুরাবাসীকে অত্যাচারী রাজার হাত থেকে রক্ষা করেন।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে এদিনে শুধু উপাবাসেও সাতজন্মের পাপ নষ্ট হয়। তাই এ দিনে উপবাসসহ শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করা হয়। এর সঙ্গে ধীরে ধীরে যুক্ত হয় মিছিল ও শোভাযাত্রার মতো অনুষ্ঠান। একসময় ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিল উপমহাদেশে বিখ্যাত ছিল। ইতিহাস লেখক ভুবন মোহন বসাক ও যদুনাথ বসাকের দুটি বই থেকে জানা যায়, জন্মাষ্টমীর মিছিল শুরু হয় ১৬ শতকে।
১৬১০ সালে ইসলাম খাঁর ঢাকা নগরের পত্তন করেন। ভুবন মোহনের মতে, এর আগে বংশালের কাছে এক সাধু বাস করতেন। ১৫৫৫ সালে তিনি শ্রীশ্রী রাধাষ্টমী উপলক্ষে বালক ও ভক্তদের হলুদ পোশাক পরিয়ে একটি মিছিল বের করেন। এর প্রায় ১০-১২ বছর পর রাধাষ্টমীর পরিবর্তে জন্মাষ্টমীর জাঁকজমকপূর্ণ একটি মিছিল বের করেন। সে উদ্যোগেই ১৫৬৫ সালে প্রথম জন্মাষ্টমীর মিছিল ও শোভাযাত্রা বের হয়।
পরবর্তীতে এ মিছিলের দায়িত্ব বর্তায় নবাবপুরের ব্যবসায়ী কৃষ্ণদাস বসাকের পরিবারের ওপর। কালক্রমে জন্মাষ্টমীর মিছিল একটি সাংগঠনিক রূপ ধারণ করে এবং প্রতিবছর জন্মাষ্টমী উৎসবের নিয়মিত অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। পরে ক্ষমতা ও অঞ্চলকেন্দ্রিক বিবর্তন ঘটে। এছাড়া পরিবর্তিত হয় মিছিলের অনুষঙ্গ। যেমন- প্রথমদিককার মিছিলে নন্দঘোষ, যশোদা, শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামকে আনা হতো। পরে যুক্ত হয় অন্যান্য অনুষঙ্গ। তবে মূল কাঠামোটিতে ছিল প্রথমে নাচগান, এরপর দেব-দেবীর মূর্তি, লাঠিসোঁটা, বর্শা, নিশান প্রভৃতি নিয়ে বিচিত্র পোশাক পরিহিত মানুষ। পটিভূমিতে থাকত নানা রকমের দৃশ্য। এ সব দৃশ্যে ব্যবহার হতো কাগজ, রং, কাপড়, মোম, চুমকি প্রভৃতি উপকরণ।
আগের মতো না হলেও ঢাকায় এখনও জন্মাষ্টমী উৎসব ও শোভাযাত্রা জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়। সাধারণত তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠান করে মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি। এছাড়া সারাদেশের বিভিন্ন মন্দিরে পূজা অর্চনা, হরিনাম সংকীর্তন ও নামযজ্ঞেরও আয়োজন করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এদিন বন্ধ থাকে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দল নেতা এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দিবসটির তাৎপর্য সম্পর্কিত বানী দেওয়া হয়।

এভাবে দিবসটি প্রতিবছর ফিরে আসে। শ্রীকৃষ্ণ ভক্তদের সিক্ত করে তার ভালোবাসা ও করুণা ধারায়। বাংলায় নদীয়া অঞ্চলে শ্রীচৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের কর্মকাণ্ড ও দর্শন নতুন একটি মাত্রা পায়।

No comments:

Post a Comment